কিউটিভি বাংলা ডেস্ক:
আওয়ামী আমলে সংঘটিত গুমের ঘটনায় দায়ের হওয়া দুই মামলার বিচার আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়েছে। গতকাল বুধবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের মাধ্যমে এ কার্যক্রম শুরু হয়। তদন্ত প্রতিবেদনে অভিযুক্তদের গ্রেপ্তারের আবেদন করলে আদালত তা আমলে নিয়ে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে।
অভিযুক্তদের মধ্যে আছেন ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, প্রধানমন্ত্রী নিরাপত্তা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক, সেনা গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআইয়ের পাঁচ সাবেক মহাপরিচালক ও পুলিশের সাবেক আইজিপিসহ মোট ২৮ কর্মকর্তা।
পরোয়ানা পাওয়া অভিযুক্তদের মধ্যে ডিজিএফআই, র্যাব ও সিটিআইবিতে কর্মরত থাকা সময়ের তিন লেফটেন্যান্ট জেনারেল, পাঁচ মেজর জেনারেল, ছয় ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, তিন কর্নেল ও পাঁচ লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদমর্যাদার সামরিক কর্মকর্তা রয়েছেন। তাদের মধ্যে ২৩ জন সামরিক কর্মকর্তা, যাদের ১১ জন এখনো সশস্ত্র বাহিনীতে কর্মরত। এছাড়া আছেন সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ। ট্রাইব্যুনাল অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার করে আগামী ২২ অক্টোবর শুনানির জন্য হাজির করতে নির্দেশ দিয়েছে।
বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন ট্রাইব্যুনাল-১ এর তিন সদস্যবিশিষ্ট প্যানেল এই আদেশ দেন। প্যানেলের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সামরিক বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দায়ের ও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি।
অভিযোগের বিবরণ
অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেল (জেআইসি) তথা আয়নাঘর ও টাস্কফোর্স ইন্টারোগেশন (টিএফআই) সেলে মোট ৩৪টি গুমের ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ আনা হয়েছে। এর মধ্যে জেআইসিতে ১৩ জন এবং টিএফআই সেলে ১৭ জনকে আসামি করা হয়েছে।
দুটি মামলায় মোট ১০টি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়। ট্রাইব্যুনালের আইন অনুযায়ী, অভিযুক্ত আসামিরা সরকারি কোনো পদে কর্মরত থাকতে পারবেন না।
জেআইসি মামলার আসামিদের মধ্যে রয়েছেন ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার নিরাপত্তা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক, ডিজিএফআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) আকবর হোসেন, মেজর জেনারেল (অব.) সাইফুল আবেদীন, লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) সাইফুল আলম, লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) আহমেদ তাবরেজ শামস চৌধুরী, মেজর জেনারেল (অব.) হামিদুল হক প্রমুখ।
অন্যদিকে টিএফআই সেলের ১৭ অভিযুক্তের মধ্যে রয়েছেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ, র্যাবের সাবেক মহাপরিচালক এম খুরশিদ হোসেন, ব্যারিস্টার হারুন-অর-রশিদ, কর্নেল আনোয়ার লতিফ খানসহ র্যাব ও সেনা বাহিনীর আরও একাধিক কর্মকর্তা।
চিফ প্রসিকিউটরের বক্তব্য
রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম, তার সঙ্গে ছিলেন প্রসিকিউটর গাজী মনোয়ার হুসাইন তামিম। তিনি আদালতে বলেন, এই আসামিরা গুম, গোপন বন্দিশালা, নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ডে জড়িত। গুমের শিকারদের ইলেকট্রিক শক, হাত কেটে ফেলা, নখ উপড়ে ফেলার মতো নৃশংস নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। গোপন বন্দিশালাগুলোকে ‘আয়নাঘর’, ‘ক্লিনিক’ বা ‘হাসপাতাল’ নামে ডাকা হতো, আর ভুক্তভোগীদের ‘সাবজেক্ট’ বলা হতো।
তাজুল ইসলাম বলেন, “জনগণের বেতনে ইউনিফর্ম পরে যারা এসব অপরাধ করেছে, তাদের দায় কোনো বাহিনীর নয়। অপরাধী ব্যক্তিকেই আইনের মুখোমুখি হতে হবে।”
ভুক্তভোগী পরিবারের প্রতিক্রিয়া
ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত ছিলেন গুমের শিকার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবদুল্লাহিল আমান আল আযমী, ব্যারিস্টার মীর আহমদ বিন কাসেম, হুম্মাম কাদের চৌধুরী ও মাইকেল চাকমা। তারা সকলেই ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করে বলেন, “বাংলাদেশে আর যেন কোনো পরিবার গুমের ভয়াবহতা না ভোগ করে।”
আবদুল্লাহিল আমান আযমী বলেন, “ডিজিএফআই আমাকে বিনা অপরাধে আট বছর গুম করে রেখেছিল। এই জুলুমের বিচার চাই।”
চিফ প্রসিকিউটর বলেন, আওয়ামী আমলে দেশে সাড়ে তিন হাজারেরও বেশি গুম সংঘটিত হয়, যার মধ্যে গুম কমিশন এক হাজার ৮৩৭টি ঘটনার অভিযোগ পেয়েছে।
ডিজিএফআইর পাঁচ সাবেক প্রধানসহ ২৮ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা


