শতাব্দীর ভয়াবহ তাণ্ডবের পর দুর্বল হলো ঘূর্ণিঝড় ‘মেলিসা’
ক্যারিবীয় অঞ্চলে শতাব্দীর ভয়াবহ তাণ্ডব চালানোর পর অবশেষে দুর্বল হয়ে পড়েছে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় ‘মেলিসা’। ঘণ্টায় ২৫০ কিলোমিটারেরও বেশি বেগে আঘাত হানা এই ঝড়ে জ্যামাইকা, কিউবা ও হাইতিতে অন্তত ৫০ জনের প্রাণহানি ঘটেছে এবং কয়েকশ’ মানুষ আহত হয়েছেন।
আবহাওয়াবিষয়ক সংস্থা অ্যাকুওয়েদার জানিয়েছে, ‘মেলিসা’ আটলান্টিক মহাসাগরীয় অঞ্চলের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ শক্তিশালী ঝড় হিসেবে রেকর্ড গড়েছে। গত ২৮ অক্টোবর এটি ক্যাটাগরি–৫ মাত্রায় জ্যামাইকার দক্ষিণ উপকূলে আঘাত হানে। বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার (ডব্লিউএমও) ঝড়বিষয়ক বিশেষজ্ঞ অ্যান-ক্লেয়ার ফন্টান বলেন,
“জ্যামাইকার জন্য এটি শতাব্দীর ঝড়। দেশটি এমন শক্তিশালী আঘাত আগে কখনও দেখেনি।”
জ্যামাইকায় বিপর্যয়কর পরিস্থিতি
ঝড়ে জ্যামাইকার বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন হয়েছেন প্রায় ৪ লাখ ৬০ হাজার মানুষ। সরকারি হিসাবে ১৯ জনের মৃত্যু হয়েছে, বহু মানুষ নিখোঁজ। জনপ্রিয় পর্যটন শহর মন্টেগো বে-তে পানির উচ্চতা কোমর সমান পর্যন্ত উঠে যায়। দেশটির অবকাঠামো, সড়ক, সেতু ও ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
অ্যাকুওয়েদার জানিয়েছে, শুধুমাত্র পশ্চিম ক্যারিবীয় অঞ্চলেই ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৮ থেকে ৫২ বিলিয়ন ডলার।
হাইতিতে ভয়াবহ বন্যা
প্রতিবেশী হাইতিতে ঝড়ের প্রভাবে ব্যাপক বন্যা দেখা দেয়। দেশটিতে ৩১ জন নিহত ও ২০ জন নিখোঁজ বলে জানিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন। দক্ষিণাঞ্চলের পেটি-গোয়ে এলাকায় নদী উপচে পড়ে একসঙ্গে ২৩ জনের মৃত্যু হয়, যাদের মধ্যে ১০ শিশু।
কিউবায় বড় ক্ষয়ক্ষতি, প্রাণহানি কম
কিউবায় আঘাত হানার সময় মেলিসা ক্যাটাগরি–৩ মাত্রায় দুর্বল হয়ে পড়ে। সেখানে বড় ধরনের প্রাণহানি না হলেও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ও গণ–উচ্ছেদ ঘটে। প্রায় ৭ লাখ ৩৫ হাজার মানুষকে সরিয়ে নেওয়া হয় নিরাপদ স্থানে।
বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (WFP) ক্যারিবীয় পরিচালক ব্রায়ান বোগার্ট বলেন,
“মাঠের অবস্থা একেবারেই ভয়াবহ। ঘরবাড়ি ধ্বংস, ফসল নষ্ট, পানির উৎস দূষিত—সব মিলিয়ে এটি এক মানবিক বিপর্যয়।”
ক্ষয়ক্ষতির সারসংক্ষেপ
-
জ্যামাইকার ৭৭% এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে।
-
মন্টেগো বে-তে পানির উচ্চতা কোমর পর্যন্ত উঠেছে।
-
শুধুমাত্র জ্যামাইকায় ২২ বিলিয়ন ডলারের অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে।
-
হাইতিতে বন্যায় অন্তত ২৫ জন প্রাণ হারিয়েছেন।
-
কিউবায় ৭ লাখের বেশি মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া হয়েছে।
বিজ্ঞানীদের সতর্কবার্তা
আবহাওয়াবিদদের মতে, মেলিসা এবারের মৌসুমের চতুর্থ ঘূর্ণিঝড় যা ২৪ ঘণ্টারও কম সময়ে ক্যাটাগরি–৫ মাত্রায় পৌঁছায়।
বিজ্ঞানীরা সতর্ক করছেন—সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে এই ধরনের ঘূর্ণিঝড়গুলো দ্রুত শক্তি সঞ্চয় করছে। এই প্রবণতাকে তারা বলছেন “র্যাপিড ইনটেনসিফিকেশন”, যা জলবায়ু পরিবর্তনের সরাসরি প্রভাব।
মানবিক সহায়তা ও পুনর্গঠন
জাতিসংঘ ও রেড ক্রস ইতোমধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় জরুরি ত্রাণ পাঠিয়েছে। আন্তর্জাতিক দাতাগোষ্ঠীগুলো জ্যামাইকা ও হাইতিতে খাদ্য, পানি, চিকিৎসা ও আশ্রয়সামগ্রী সরবরাহ শুরু করেছে। তবে অবকাঠামোগত বিপর্যয়ের কারণে অনেক এলাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন।
বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা সতর্ক করেছে, ঝড়টি এখন দুর্বল হলেও তার বৃষ্টিপ্রবণ লেজ মধ্য আমেরিকার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, যা আগামী কয়েকদিন ভারী বর্ষণ ও ভূমিধসের আশঙ্কা বাড়াতে পারে।


