ফেরেনি গুমের শিকার ৩৫০ জন: কেউ জানে না আর কতকাল অপেক্ষা
ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে গুম হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে এখনো অন্তত ৩৫০ জন ফিরে আসেননি। তাদের জীবিত না মৃত—সে খবরও জানে না কেউ। গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের পতনের পরও নিখোঁজদের পরিবারের দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটেনি।
‘মায়ের ডাক’ নামের সংগঠনটির তথ্য অনুযায়ী, আওয়ামী লীগ শাসনামলে ৭০৫ জন ব্যক্তি গুমের শিকার হন। এর মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষমতায় আসার পর অনেকেই ‘আয়নাঘর’ থেকে মুক্তি পেয়েছেন, তবে এখনো প্রায় সাড়ে ৩০০ জনের কোনো হদিস মেলেনি।
১১ বছর বয়সি আরাফ হোসেন পৃথিবীর আলো দেখার কয়েক মাস আগে তার বাবা পারভেজ হোসেনকে রাজধানীর শাহবাগ থেকে ডিবি পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। আজও ফেরেননি তিনি। আরাফ এখন মাতুয়াইল আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। চোখে জল এনে সে বলে,
“আমি কখনো বাবাকে দেখিনি। শুধু ছবিতে দেখি। আমি কিছুই চাই না, শুধু বাবাকে ফিরে পেতে চাই।”
পারভেজ ছিলেন বংশাল থানা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক। তার স্ত্রী ফারজানা আক্তার দুই সন্তানকে নিয়ে এখন বোনের বাসায় মানবেতর জীবন যাপন করছেন। তিনি যুগান্তরকে বলেন,
“২০১৩ সালে স্বামীকে তুলে নেওয়ার পর থেকে আজও কোনো খোঁজ পাইনি। ৫ আগস্টের পর আশা করেছিলাম তিনি ফিরবেন। কিন্তু এখনো ফিরে আসেননি। দুই সন্তান নিয়ে টিকে থাকা কঠিন হয়ে গেছে।”
‘মায়ের ডাক’-এর সমন্বয়ক আফরোজা ইসলাম বলেন,
“যেসব পরিবার এখনো স্বজনকে ফিরে পায়নি, তাদের অবস্থা ভয়াবহ। অনেকে নিঃস্ব হয়ে গেছে। সরকার এখন যাদের ফিরিয়ে আনছে, তাদের নিয়েই বেশি কাজ করছে। যারা এখনো নিখোঁজ, তারা যেন ভুলে যাওয়া মানুষ।”
অন্যদিকে, গঠিত কমিশন অব ইনকোয়ারি অন এনফোর্সড ডিসঅ্যাপিয়ারেন্সেস এখনো স্পষ্ট কোনো তথ্য দিতে পারেনি। কমিশনের সভাপতি অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী বলেন,
“যেসব অভিযোগ আমাদের কাছে এসেছে, সেগুলোর অনুসন্ধান চলছে। যারা এখনো নিখোঁজ, তাদের বিষয়ে বিস্তারিত আমরা ফাইনাল রিপোর্টে বলব।”
রাজধানীর সূত্রাপুর, পল্লবী ও মিরপুরের বিভিন্ন এলাকায় গুম হওয়া অনেক ব্যক্তির পরিবারের গল্প একই রকম। কেউ তাদের উপার্জনক্ষম স্বজন হারিয়েছেন, কেউ হারিয়েছেন পরিবারের একমাত্র সন্তান।
মিরপুরের ব্যবসায়ী কুদ্দুসুর রহমান চৌধুরী ২০১৪ সালের ১ জানুয়ারি নিখোঁজ হন। তার মেয়ে টুম্পা জানান,
“আমরা কমিশনে অভিযোগ দিয়েছি, ট্রাইব্যুনালেও মামলা করেছি। কিন্তু বাবার কোনো হদিস পাইনি। এখন শুধু অপেক্ষা করছি।”
গুমসংক্রান্ত কমিশনের সর্বশেষ প্রতিবেদন বলছে, গত বছরের ৫ আগস্টের পর প্রাপ্ত প্রায় ১,৯০০ অভিযোগের মধ্যে ২৫০টির অকাট্য প্রমাণ মিলেছে। অধিকাংশ ভুক্তভোগী রাজনৈতিকভাবে বিএনপি ও বিরোধী দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। অনেককেই পরবর্তীতে ‘জঙ্গি ট্যাগ’ দেওয়া হয়।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে র্যাব, পুলিশ, ডিবি, সিটিটিসি, ডিজিএফআই ও এনএসআই—এই ছয়টি সংস্থার সদস্যরা প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। তাদের মধ্যে অনেককেই ইতোমধ্যে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং ৪২ কর্মকর্তার পাসপোর্ট বাতিল করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালও কয়েকজনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে।
এছাড়া অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, কিছু গুম হওয়া ব্যক্তিকে ভারতের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল। কমিশন ২০০৯ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে বাংলাদেশের নিখোঁজদের তালিকা ভারতের কাছে চাইলেও, ভারত অসম্পূর্ণ তালিকা দিয়েছে বলে জানায় কমিশন।
আজও আরাফের মতো শত শত শিশু প্রতিদিন দরজার দিকে তাকিয়ে থাকে এই আশায়—হয়তো একদিন বাবা ফিরবেন। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় সে অপেক্ষা ক্রমেই ভারী হয়ে উঠছে, আর নীরবতার দেয়াল পেরিয়ে কেউ উত্তর


